অধিবেশণের উদ্দেশ্যঃ
এই অধিবেশণ শেষে আপনি-
১. ধারণা পাবেন বা বুঝতে পারবেন, হঠাৎ কোন সংকটকালীন পরিস্থিতিতে কিভাবে নিজে এবং অন্যনারা টিকে থাকি এবং তার সম্ভাব্য উপায়গুলো কি কি
২. এ ধারণার মাধ্যমে, সংকটে আছেন এমন ব্যক্তির মানসিক অবস্থা বুঝতে কিছুটা সমর্থ হবেন।
সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিঃ
প্রতিটি মানুষ জীবনে কিছু সঙ্কটকালীন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন এবং এটাই স্বাভাবিক। যেমন- কোন দূর্ঘটনা, দূর্যোগ, সম্পর্কে জটিলতা, সহিংসতার শিকার ইত্যাদি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, সঙ্কটকালে মানুষের যে যে প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে তা স্বাভাবিক, কেননা এরকম অস্বাভাবিক পরিপ্রেক্ষিতে এমন হতেই পারে। কার্যকরীভাবে সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে সাহায্য করতে গেলে এমন তথ্য, কার্যকলাপ ও পরিকাঠামো দেওয়া দরকার যাতে সঙ্কট অতিক্রম করে মানুষ আবার তার আগের মানসিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারে।
সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মূল কথা হলো সঙ্কটের মুখোমুখি হতে পারা। বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে সংকটকালীন পরিস্থিতিতে সহায়তা করতে গিয়ে তা যেন মানুষটির সমস্যাকে দীর্ঘায়িত না করে এবং মানুষটির নিজের ও আশেপাশের অন্যমানুষের জীবনে আরো সমস্যা ডেকে না আনে। পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া ও আলোচনা করা সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলার অন্যতম উপায়।
আপনার বোঝার জন্য, সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলার ৮ টি প্রয়োজনীয় উপাদান নীচে উল্লেখ করা হলোঃ
ক. শিক্ষা
বেশিরভাগ মানুষেরই সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বেরিয়ে আসতে পারার একটা সহজাত ক্ষমতা থাকে। তবে এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহায়তা, নির্দেশনা ও বিভিন্ন উপায় থাকাও দরকার।
খ. পর্যবেক্ষণ ও সচেতনতা
সঙ্কট নানা কারণে আসতে পারে, যেমন-আত্মসচেতনতার অভাব, নিজের বা অন্যদের উপর নিজের ব্যবহারের প্রভাব। সচেতন থাকলে অনেক উপায় খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হতে পারে ও ভালো থাকা সম্ভব হয়। সমস্যার দিকে না তাকালে এবং সমস্যার/নিজের দায় স¤পর্কে সচেতন না হলে সমস্যার মোকাবেলা করা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে, পরিবারের নিজস্ব গঠনগত ও ভাবের আদান প্রদানগত সমস্যা সঙ্কটকে দীর্ঘায়িত করে।
গ. নিজের শক্ত ক্ষমতার প্রকাশ ও ব্যবহার
প্রতিটি সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি ব্যক্তিগত বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি করে এবং ব্যক্তির মধ্যে সর্বোচ্চ সুপ্ত সম্ভাবনার প্রকাশ করে। সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে যে নিজেকে খুব সাহসী বলে মনে করে সেই সফল মানুষ হবে এমন নয়, বরং জীবনে অপরিহার্য এবং দুঃখজনক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গুণ ও যোগ্যতার প্রকাশ যে করতে পাওে, সেই প্রকৃত ভাবে সঙ্কট অতিক্রমকারী সফল মানুষ।
যদিও সহায়তার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সংকটের মধ্যে থাকা মানুষটিকে সুযোগ দেওয়া হবে না বা উৎসাহিত করা হবে না বা তার নিজের জীবনের সঙ্কট মোকাবিলা বা গুণগত মান উন্নয়নে তাকে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হবে না।
ঘ. নিজের সমস্যা বোধগম্য হওয়া
প্রত্যেক মানুষেরই মূল লক্ষ্য থাকে সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন উপায় ও যোগ্যতার সর্বোত্তম ব্যবহার করা। যে কোনো সঙ্কটকালে প্রকৃত ও মনের গুরুত্বপূর্ণ ইচ্ছা বা অভিপ্রায়কে চিহ্নিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই অভিপ্রায়টা মনে রাখা খুব দরকার। আপনি কি করছেন বা কতটা দক্ষতার সাথে করছেন, সেটা বড় কথা নয়। যদিও সাধারণত আমাদের অভিপ্রায় থাকে জীবনকে আরো সুন্দর করে তোলা, কখনও কখনও আমাদের ব্যবহার ভুল পথে চালিত হতে পারে, লোকে ভুল বুঝতে পারে বা যতটা আমরা আশা করছি ততটা কার্যকারী নাও হতে পারে। নিজেকে বোঝা এবং অন্যরা আমাদের কিভাবে দেখে, তার মধ্যে নিজেকে পুনরুদ্ধারের গুরুত্বপূর্ণ চাবি লুকিয়ে থাকে।
ঙ. প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করা
সঙ্কটকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা ও সহায়তার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, একটা সামাজিক পরিবেশে’র ব্যবস্থা করা যেখানে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে পারে, অনুসন্ধান করতে পারে এবং সক্রিয় হয়ে ওঠে যাতে সঙ্কট আরো দীর্ঘায়িত না হয়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে চরম বেদনার দিনেও কার্যকলাপ ও দৈনন্দিন কার্যাবলী করে থাকি যা আমাদের আরাম ও সহায়তা দেয়। এর মধ্যে মদ, ঔষধ বা অন্যান্য নেশাদ্রব্য থাকে না। কেবলমাত্র শারীরিক বা মানসিক বিপর্যয়ের সময় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
চ. অযৌক্তিক বিশ্বাস এবং অবাস্তব প্রত্যাশাকে আঘাতকরা
কিছু মানুষের সঙ্কটকালে এমন প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকে যাতে তারা নিজেদের চিন্তাভাবনা, কল্পনা, নিজের বা অন্যদের থেকে প্রত্যাশা স¤পর্কে বিশ্লেষণ করতে পারে। কিন্তু আমাদের অনেকেই নিজেদের চিন্তা- ভাবনা, যেগুলোর দিকে আমরা লক্ষই করি না, তা আমাদের অনুভূতি ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া উপর অনেকাংশে প্রভাব ফেলে।
ছ. দুষ্ট চক্র ও আসক্তির অভ্যাসকে নষ্ট করা
বেশিরভাগ সঙ্কটকালীন সময়ে কিছু দুষ্ট চক্র ও আসক্তি থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, নেশা ও মাদক দ্রব্যাদির ব্যবহার শুধুমাত্র আমাদের জীবনকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় না এটা আমাদের নিজেদের, অন্যদের বা আশপাশের পৃথিবী স¤পর্কেও আমাদের মনে অনুভূতি ধোঁয়াশা তৈরি করে। যখন অনুভূতিগুলো রাসায়নিক দ্রব্য, ঔষধ পত্র, মাদকদ্রব্য, ও অন্যান্য নেশাদ্রব্য দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন মানুষ নিজেদের অনুভূতি বুঝে উঠতে পারে না। খুব যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। মানসিক যন্ত্রণা থেকে অস্বাস্থ্যকর ভাবে পালিয়ে বাঁচার জন্য মানুষ নানা কাজ করে, যেমন- ঔষধ খায়, নেশাদ্রব্যে, মদে, যৌন সংযোগে আসক্ত হয়, রোমাঞ্চকর কাজ কর্মে লিপ্ত হয়, পার্টিতে যায় বা অত্যধিক কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করে।
নিজেকে প্রবঞ্চিতের ভূমিকায় দাঁড় করালে অন্যরা একজন সংকটে থাকা মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সঙ্কটের মোকাবেলা না করে সঙ্কটকে দীর্ঘায়িত করলে কিছু সহানুভূতিশীল স¤পর্ক তৈরি হয়। যখন কোন মানুষ অন্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে ও ভালো অনুভূতির দিকে যাওয়া এড়িয়ে চলে, তখন একটা দুষ্ট চক্র তৈরি হয়। দুষ্ট চক্র তৈরি হয় এমন ব্যবহার, মানসিক যন্ত্রণা এড়াতে সাহায্য করে, কিন্তু পরিণামে এগুলো যে সমস্যা এড়াতে চাইছি সেই একই সমস্যা বা আরো সমস্যা ডেকে আনে, দুষ্ট চক্রের মধ্যে যে ব্যবহার দেখা যায় বাস্তবে তা সঙ্কটকে দীর্ঘায়িত করে।
সাময়িক নির্ভরশীলতা তৈরি করে- সঙ্কটকালে, কখনও কখনও অন্যদের সাথে স্বল্পকালীন স¤পর্ক সহায়ক হয়। সঙ্কটকালীন মোকাবেলা ও সাহায্য খুবই উপকারী ও প্রয়োজনীয়। সুস্থ নির্ভরশীলতার স¤পর্ক সাধারণত সাময়িক হয় এবং সর্বদাই স্বাবলম্বীতার দিকে নিয়ে যায়। অস্বাস্থ্যকর নির্ভরশীলতা দীর্ঘকাল চলতে থাকে এবং স্বাবলম্বীতার পরিবর্তে নির্ভরশীলতাকে প্রশ্রয় দেয়।
ভয় নামক মানসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি হওয়া- সংকটকাল বলতে সাধারনত আমরা ভয় বা দুঃখের সময়কে বুঝি আমরা কিভাবে প্রতিক্রিয়া করি তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভয় বা দুঃখ তৈরী হয়ে থাকে। যখন আমরা আমাদের জীবনে অন্ধকার দিনের মুখোমুখি হই, তখন আমরা ভয় বা দুঃখের দ্বারা ভেঙ্গে পড়ি না, বরং আবিষ্কার করি যে আমরা বাঁচতে পারি। সময়ের সাথে সাথে আমরা অনুভব করি যে আমাদের যন্ত্রণা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। মানসিক যন্ত্রণায় মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে সুস্থ প্রতিক্রিয়া। তার মানে এই নয় যে আমরা আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবো। কিন্তু চিন্তা ও অনুভূতিগুলি এড়িনোর কাজে নিজেদের লিপ্ত করে অহেতুক আমাদের শক্তি ক্ষয় করবো না। যখন মানুষ যন্ত্রণা ভোগ করে, তখন সে যাতে নিজেকে একা না ভাবে তার জন্য তাকে সাহায্য করা দরকার। মানুষের জীবনের সমস্যার সমাধানের জন্য তাকে সাহায্য করা প্রয়োজন। মানসিক যন্ত্রণার সময় মানুষকে সহায়তা করা ও শক্তিমান করে তোলা দরকার।
আশাকরি উপরের দেওয়া তথ্যগুলো আপনি পড়েছেন এবং সেগুলো ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবেন।